শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ১০:২৯ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :

চোর-চুন্নীর গান

(একটি লোকায়ত সংস্কৃতির ক্ষয়িষ্ণু রসভান্ডার)
বাদল বিহারী চক্রবর্তী: শুনে হাসি বা কৌতূহলের উদ্রেক হতেই পারে সর্ববৃহৎ জনজাতিসম্পন্ন পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের এ অদ্ভুত লোকসংস্কৃতির প্রসঙ্গে। একটা সময় ছিল, ভারতের উত্তরবঙ্গের মানুষের লোকায়ত বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল ‘চোরা-চুরনির গান’ বা ‘চোর-চুন্নীর গান’। গ্রামীণ এ ঐতিহ্যের বিনোদনে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে থাকতখোল, করতাল, বাঁশি, সারিন্দা, জুরি ইত্যাদি। আর এ চোর-চুরনির গানের প্রস্তুতিটা বিশেষ করে দুর্গাপূজার পর থেকেই শুরু হয়ে একেবারে দীপান্বিতা-কালীপূজার রাত অব্দি চলত। সারা উত্তরবঙ্গের গ্রামে-গঞ্জে দাপিয়ে বেড়াত একদল স্থানীয় লোকশিল্পী; যাদেরকে ওখানকার আঞ্চলিক ভাষায় ‘গিদাল’ বলা হয়ে থাকে। আট-দশ জনের একেকটি দলে একজন ছকরি (নর্তকী) ও একজন ছকরা (নর্তক) একপ্রকার রসাত্মক নাচ করতেন। দলের এ দুজনের প্রসঙ্গে এলাকার রাজগঞ্জের লেখক ও সংগ্রাহকরামপ্রসাদ মোদক মহাশয়ের লেখা একটি নিবন্ধে জানা যায়, ‘তারাই চোর চুরনির অভিনয় করে নাচতেন। গানগুলোর মধ্যে মানুষের ভাবাবেগ, প্রেম, বিরহ, সামাজিক সমকালীন ঘটনাবলী স্থান পেত’। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, আলিপুরদুয়ার জেলার বিশিষ্ট আঞ্চলিক সঙ্গীতরীতির এ গানগুলো মূলত পশ্চিম ডুয়ার্সের গ্রামাঞ্চলের রাজবংশী কৃষক সমাজের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত। দলের সবাই এ সময় যে গানগুলো গাইতেন, সেগুলো তাদের রাজবংশী ভাষাতেই গাওয়া হতো।
বর্ণনীয় বিষয়: এটা অনস্বীকার্য যে, সমাজের প্রায় সকল শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে চোর এবং চুরনিরা চিরকাল নিন্দিত এবং অজ্ঞাত। কিন্তু, ওরাও তো মানুষ, ওদের জীবনচর্যাতেও আছে বিরহ-যন্ত্রণা, আশা-আকাক্সক্ষা, আছে অভাব-অভিযোগ। আর তাই, কৃষক লোককবিগণ তাদের প্রতি সহমর্মী হয়ে গানের মাধ্যমে চিত্রিত করেছেন এক নৃত্যগীত, ‘চোর’ ও ‘চুরনি’ নামক গোবেচারাদের শিখ-ী হিসেবে সামনে রেখে; প্রতীক স্বরূপে। গানের পালাগুলোতে চোর ও চুরনির জবানীতে সমকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যঙ্গরসাত্মক বা ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের অভিব্যক্তিপূর্ণ বা লোকশিক্ষামূলক বিষয় গ্রামীণ শ্রোতাদের বিনোদন যেমন দেয়, আবার বিষণœও করে, যেন জীবনের এক দুঃসহ কষাঘাত বর্ণনার আলেখ্য। বিবরণ: গাঁয়ের অবস্থাসম্পন্ন কৃষকের (যারা উল্লিখিত অঞ্চলে গিরি/ধনী বা দেওয়ানী নামে পরিচিত) পৃষ্ঠপোষকতায় কার্তিকের এ সময়গুলোতে গঠিত একেকটি দল তার বাড়ির অঙ্গনে নিয়মিত গানের তালিম নিয়ে থাকে। অতঃপর নির্দিষ্ট পরিবেশনা উপহার দেওয়ার নিমিত্তে ওরা পূর্বনির্ধারিত বিভিন্ন স্থানে পালা প্রদর্শনে বেরিয়ে পড়ে। জোতদারের বাড়িতে চুরি করতে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে চোর তার স্ত্রী চুন্নীর কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলে চুন্নীর তখন মানসিক শঙ্কার যে প্রকাশ, তা রাতের আঁধারে এক গ্রামীণ অবলা দরিদ্র নিরক্ষর নারীর করুণ একাকীত্বেরই প্রতিচ্ছবি।
স্থানে স্থানে পরিবেশিত গানগুলোর শুরুতে সর্বসাফল্য লাভের কামনায় চোর চক্রপতি কৃষ্ণ ও স্থানীয় লৌকিক দেব-দেবীর বন্দনা গেয়ে নেয়। এরপর চোর-চুন্নীর গায়করা চাপান ও উতোরের কিছু অংশ গেয়ে ছেড়ে দিলে দোহাররা তার রেশ ধরে বিস্তৃত করে গেয়ে যান সম্মেলক সুরে। আর তাই, দলে থাকেন একজন মূল গায়েন; তার দোহার রূপে দলে থাকেন কয়েকজন সুকণ্ঠী সহগায়ক। এদের মধ্যে একজনকে ‘চোর’ ও আরেকজনকে ‘চুন্নী’ সাজানো হয়। বলছিলাম, চুরি করার উদ্দেশ্যে চোর নিজের ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে চুন্নীর যে ভীত ও ভারাক্রান্ত মনের অবস্থা, তা চুন্নী তার কান্নাবিজরিত গানে স্বামীকে বোঝাতে চায়। আঞ্চলিক ভাষায় গানটি
চুরনি : ও আই (মো) মোক দিলেন কি দেখি,
মোর কপালে মিলিল চোরা সয়ামি একি।
আগ-পাছ না দেখিলেন, আই পাশ পড়শি না পুছিলেন।
চোরা যাচ্ছে চুরি করির, মোক নাগেছে জিগির জিগির।
ক্যামনে পহাইম আই আন্ধার আতি (রাত)।
মোক ছাড়িয়া চোর করিবার যাছে পরান পাতি।
একে ঘরে সন্দেয়া আই কান্দিয়া মুই বুক ভিজাই,
এ জনম মোর ব্যথায় গেল হোনু চোরের নারী।
কিন্তু চোর তার এ দারিদ্র্যপীড়িত নিরাভরণা স্ত্রীকে বনেদি সুখী মানুষের স্ত্রীর মতো মূল্যবান অলংকার ও পোশাক-প্রসাধনে সজ্জিত করতে চায়। তাই, বেচারা চোর হাসিমুখে বিদায় চায় এবং স্ত্রীকে আশ্বস্ত করতে এই বলে যে, তার নিজের চৌর্যবৃত্তির কৌশল অতি সুনিপুণ। স্ত্রীকে প্রবোধ দেওয়া স্বামী (চোর) তার স্ত্রীর গানের প্রতিউত্তরে যে স্বস্তিমূলক গান গায় তা
চোর : চুরি করিবার যাছ চুন্নী আলিপুরদুয়ার,
আজি চট করিয়া করেক তুই খাবার, অমাবষ্যার আন্ধার আতি,
জুটিসে মোর সঙ্গসাথী, আনিম কত জিনিসপাতি
সোনার অলংকার। যদি কোনও মতে বিধি বিপদ না দেয় আর।
ও তোর ঠেঙ্গা পিন্দাইম চুন্নী, গজমতি হার।
আরও আনিম কাটা কাপড়-চোপড়, দেখিলে খাবো ফোঁপর,
কতয় রকম বছর বছর থাকেক চুন্নী না নাগে ভাবিবার।
চুন্নীর সাজের মূল্যবান সামগ্রী ছাড়াও চোরের স্বপ্নসে তার চৌর্যবৃত্তির অর্থের বিনিময়ে নিকটস্থ কোনো চাষের জমি কিনবে; আর সেই সুবাদে নিজে সম্পদের অধিকারী হলে ‘চুন্নী’ও হয়ে ওঠবে এক দিন আর্থিক ধনবানের স্ত্রী। এত আশ্বাস সত্ত্বেও পল্লির অজগাঁয়ের এক অশিক্ষিতা নারীর সন্দিগ্ধ মন থাকে শঙ্কা ও দুর্ভাবনায় আচ্ছন্ন। এমন একটি লোকগান পরিবেশনার কাহিনীপট যখন বিস্তৃত হতে থাকে, গানের মাধুর্যে গৃহস্থ কৃষক স্রোতাবর্গ তখন এর মধুরস পান করেন, আর খুশিতে তারা গানের দলটিকে পারিতোষিক হিসেবে চাল-ডাল ও নগদ অর্থ প্রদান করে উৎসাহিত করেন। তবে উৎসাহিত করলেও হতাশার কারণ হচ্ছে এতাদৃশ ক্ষয়িষ্ণু লোকসংস্কৃতিকে বুঝি আর ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাই, আবার রামপ্রসাদ মোদক মহাশয়ের সঙ্গে আমারও দুঃখবোধ‘কালের স্রোতে ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে এই গান। আধুনিক টিভি ধারাবাহিক, পাশ্চাত্যের পপ গানের ঠেলায় ডারউইনের মতবাদকে মেনে আজ অবলুপ্তির পথে।’ তবে এ সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে হলে আঞ্চলিক লোকপ্রিয় অর্থাৎ, উত্তরবঙ্গের রাজবংশী শিক্ষিত সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে বলে ড. গিরিজা শঙ্কর রায় মনে করেন। ভারত সরকারের সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত এ লোকসংস্কৃতি লেখক ও কবি ড. রায়, যার সঙ্গে হয়তো সব লোকসাহিত্যানুরাগীরাই সহমত পোষণ করবেন। আমরাও চাইবিশ্বের সব জাতি-ধর্ম-বর্ণ বা গোষ্ঠী কিংবা ক্ষুদ্র ও মাঝারি নৃগোষ্ঠী তথা আদিবাসীদের নিজস্ব সকল বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান অটুট থাকুক; পুনরুজ্জীবিত হোক আঞ্চলিক লোকায়ত সংস্কৃতি। চোর-চুন্নীর গানের শিল্পরস ছড়িয়ে পড়ুক সারা বিশ্বের রসপিপাসুদের মানসমন্দিরে।
তথ্যসূত্র : ** বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ, দুলাল চৌধুরী, একাডেমি অব ফোকলোর, কলকাতা-৭০০০৯৪। ** ড. বরুণ কুমার চক্রবর্তী সম্পাদিত (১৯৯৫) বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতিকোষ, কলকাতা। ** রামপ্রসাদ মোদক, রাজগঞ্জ।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877